প্রস্রাবের রং কালো। একটি জেনেটিক রোগ
প্রস্রাবের রং কালো হতে পারে?
প্রস্রাব সাধারণত সাদা বা হলুদ রঙয়ের হয়ে থাকে। কিন্তু প্রস্রাবের রং কালো ও হতে পারে। অবশ্যই এটি কোনো স্বাভাবিক অবস্থা না। আসুন জেনে নেই কী কারণে প্রস্রাব কালো হয়।
এটি একটি জেনেটিক ডিসঅর্ডার যার নাম ‘আলকাপটোনুরিয়া’ (Alkaptonuria)। আমরা জানি যে অ্যামিনো অ্যাসিড হলো প্রোটিনের বিল্ডিং ব্লক। আমরা যখন প্রোটিন খাই, তখন আমাদের শরীর এই প্রোটিনগুলিকে ভেঙে শক্তি তৈরি করে। প্রোটিন ভেঙে ফেলা মানে অ্যামিনো অ্যাসিড ভেঙে ফেলা। কিন্তু যখন আমাদের শরীর অ্যামিনো অ্যাসিড গুলো সঠিকভাবে পারে না তখন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। টাইরোসিন এবং ফিনাইলএলানিন নামে দুটি অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে । আমাদের শরীর যখন টাইরোসিন এবং ফিনাইলএলানিনকে ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয় তখন তারা এই কালো প্রস্রাবের রোগের (আলকাপটোনুরিয়া) জন্য দায়ী হয়।
কেন প্রস্রাব কালো হয়ঃ
একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের শরীরে ফিনাইলএলানিন এবং টাইরোসিন কয়েকটি ধাপে ভেঙ্গে ম্যালেইলএসিটোএসিটিক এসিডে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে এসিটাইল-কোএ তে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে। ‘ Homogentisate dioxygenase ‘ নামে একটি এনজাইম রয়েছে যা ফিনাইলএলানিন এবং টাইরোসিনকে ম্যালেইলএসিটোএসিটিক এসিডে রূপান্তর করতে সাহায্য করে। সুতরাং, যদি এই এনজাইমটি ত্রুটিযুক্ত হয় বা সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে তবে ফিনাইলএলানিন এবং টাইরোসিন এসিটাইল-কোএ তে রূপান্তরিত হবে না। তখন হোমোজেন্টিসিক অ্যাসিড শরীরে প্রচুর পরিমাণে জমা হবে যা আর ভাঙা যাবে না। অতিরিক্ত হোমোজেন্টিসিক এসিডের কারণে প্রস্রাবের রঙ কালো হয় এবং বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে যা
অ্যালকাপটোনুরিয়া বা ‘ব্ল্যাক ইউরিন ডিজিজ’ নামে পরিচিত। এটি একটি খুব বিরল জিনগতভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্যাধি। তার মানে জন্মগত ভাবেই এই ব্যাধি নিয়ে জন্মায়। আমরা জানি আমাদের শরীরে 23 জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে। প্রতিটি ক্রোমোজোমের একটি জোড়া প্রতিটি পিতামাতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। HGD-জিন যেটি homogentisate এনজাইম তৈরির নির্দেশনা প্রদান করে তা মা ও বাবা উভয়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। যদি শুধুমাত্র পিতামাতার যেকোনো একজনের মধ্যে এই HGD জিনটি ত্রুটিপূর্ণ থাকে তবে সন্তানের মধ্যে এটি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করবে না। কিন্তু যদি পিতা-মাতার উভয়ের মধ্যেই ত্রুটিপূর্ণ HGD জিন থাকে তবে শিশুটি ত্রুটিপূর্ণ HGD জিনের দুটি কপি উত্তরাধিকার সূত্রে পাবে যা অবশেষে সেই শিশুর কালো প্রস্রাবের রোগের কারণ হবে।
Alkaptonuria রোগের লক্ষণঃ
- হাড় এবং জয়েন্টে সমস্যা
Alkaptonuria রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যখন ২০ বছর বা ৩০ বছরে পৌছায় তখন থেকে জয়েন্টে সমস্যা শুরু হতে পারে। পিঠে, হাঁটুতে, নিতম্বে এবং কাঁধে ব্যথা অনুভুত হবে। পরবর্তীতে অস্টিওআরথ্রাইটিস এ আক্রান্ত হতে পারে। হাড়ের গঠন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ভঙ্গুর হয়। জয়েন্টে এবং মেরুদন্ডে ক্ষতি সাধন হয়।
- চোখ এবং কানে সমস্যা
Alkaptonuria রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কানের তরুণাস্থি শক্ত হয়ে যায় এবং তরুণাস্থি নীল বর্ণ ধারণ করে। কানের ময়লা কালো বা বাদামি বর্ণ ধারণ করে। অনেকের ক্ষেত্রে চোখের সাদা অংশে বাদামি স্পট দেখা দেয়।
- ত্বক এবং নখ
ত্বকের যেসব অংশ সূর্যের সংস্পর্শে আসে সেসব অংশে ত্বকের রং পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। ত্বকে কালো অথবা নীল দাগ দেখা যায়। নখ নীলাভ রঙের হয়ে উঠে।
- শ্বাস-প্রশ্বাস এ সমস্যা হয়
- কিডনিতে পাথর হতে পারে
- হার্টের চারপাশে অতিরিক্ত হোমোজেন্টিসিক এসিড জমলে হার্ট শক্ত হয়ে যেতে পারে
- রক্ত নালী গুলো দুর্বল হয়ে পড়ে
Alkaptonuria প্রতিরোধ করার উপায়:
যেহেতু এটি একটি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্যাধি, বর্তমানে এর কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা নিরাময় নেই। তবে, Nitisinone নামক একটি ওষুধ রয়েছে যা শরীরে হোমোজেন্টিসিক অ্যাসিডের মাত্রা কমাতে পারে তবে এটি এখনও অ্যালকাপটোনুরিয়া রোগের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত নয়। তবে শৈশবকালেই Alkaptonuria ধরা পড়লে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। সুতরাং, যাদের অ্যালকাপটোনুরিয়া রোগ আছে তাদের কম প্রোটিন জাতীয় খাদ্য খেতে হবে যাতে শরীরে টাইরোসিন এবং ফিনাইলএলানিনের মাত্রা কম থাকে। কখনও কখনও শারীরিক ব্যায়াম এই অবস্থা বজায় রাখতে অনেক সাহায্য করে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত যদি এই ব্যাধিটি লক্ষ্য করা না হয় বা উপেক্ষা করা হয় তবে এটি অনেক গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে যেমন জয়েন্ট এবং হাড়ের ব্যথা, বাত, চর্মরোগ, হার্ট, কিডনি এবং প্রোস্টেট সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে।
Similar contents:
1.ইথিলিন গ্লাইকল বিষাক্ততা। A true story.
2 thoughts on “প্রস্রাবের রং কালো। একটি জেনেটিক রোগ”